Jataka Samagra-জাতক সমগ্র

কপোত জাতক

কপোত জাতক

পুরাকালে ব্রহ্মদত্ত যখন বারাণসীর রাজা ছিলেন, তখন বোধিসত্ত্ব একবার পারাবতরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেকালে বারাণসী নগরের লোকেরা পুণ্যকামনায় পায়রা প্রভৃতি পাখিদের সুবিধা ও আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় খড় দিয়ে বুড়ি তৈরী করে ঝুলিয়ে রাখত।

পারাবত বা পায়রারূপী বোধিসত্ত্ব এইরকম একটি ঝুড়িতে বাস করতেন। বারাণসী নগরের প্রধান শ্রেষ্ঠীর পাচক তার রান্না ঘরের পাশে একটি ঝুড়ি রেখেছিল। বোধিসত্ত্ব প্রধান শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে রাখা ঝুড়িতেই বাস করতেন। তিনি রোজ সকালে উড়ে গিয়ে আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন। আবার সন্ধ্যা হতেই ফিরে এসে সেই ঝুড়ির ভিতর শুয়ে থাকতেন।

একদিন এক কাক শ্রেষ্ঠীর বাড়ির রন্ধনশালায় উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সে তখন মাছ ও মাংস রান্নার গন্ধ পেল। কিভাবে সে কিছু মাছমাংস খেতে পাবে, কিভাবে তার মনের ইচ্ছা পূরণ হবে তা ভাবতে ভাবতে সে সেই রন্ধনশালার কিছুদূরে বসে রইল।

তারপর সে পারাবতরূপী বোধিসত্ত্বকে রন্ধনশালায় ঢুকতে দেখে ভাবল, এই পায়রাটিকে অবলম্বন করে অর্থাৎ তার সাহায্যেই তার কার্যসিদ্ধি করতে হবে।

পরদিন সকালেই কাক রান্নাঘরের কাছে গিয়ে হাজির হলো। তারপর বোধিসত্ত্ব বাসা ছেড়ে খাবার সংগ্রহের জন্য যাত্রা করলে সেও তাঁর পিছু পিছু গেল। তখন বোধিসত্ত্ব কাককে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্র, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছ কেন?

কাক বলল, প্রভু আপনার চালচলন আমার ভাল লেগেছে, আমি এখন হতে আপনার অনুচর হয়ে থাকব।

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমার খাদ্য একরকম, তোমার খাদ্য অন্যরকম। সুতরাং আমার অনুচর হয়ে থাকলে তোমার অসুবিধা হবে।

কাক বলল, প্রভু আপনি যখন আহার অন্বেষণ করবেন, তখন আমিও আমার আহার সংগ্রহ করব। আমি সব সময় আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকব।

বোধিসত্ত্ব বললেন, বেশ তাই হোক। তবে তোমাকে খুব সাবধানে চলতে হবে।

এইভাবে কাককে সতর্ক করে দিয়ে বোধিসত্ত্ব চরতে চরতে তৃণবীজ খেতে লাগলেন। আর কাকও গোবরের নীচে যেসব কাঁট থাকত তা আহার করতে লাগল।

কাক তার আহার শ্রেয় করে এসে বোধিসত্ত্বকে বলল, আপনি প্রচুর আহার করেন। এত খাওয়া ভাল নয়।

বোধিসত্ত্ব তখন জাহার শেষ করে বাসার দিকে চললেন। কাকও তার সঙ্গে সঙ্গে যেতে লাগল। শেষে বোধিসত্ত্ব যখন রন্ধনশালায় ঢুকলেন তখন কাকও তাঁর সঙ্গে সেখানে ঢুকে পড়ল। পাচক ভাবল, আজ পারাবতের সঙ্গে আর একটি পাখি এসেছে। হয়ত সে পারাবতের বন্ধু।

এই ভেবে পাচক আর একটি ঝুড়ি ঝুলিয়ে দিল। সেই থেকে কাক বোধিসত্ত্বের সঙ্গে রন্ধনশালায় বাস করতে লাগল।

একদিন শ্রেষ্ঠী প্রচুর মাছ মাংস এনে রন্ধনশালায় পাচকের কাছে পাঠিয়ে দিল। তা দেখে কাকের মাছমাসে খাবার লোভ হলো। সে মনে মনে স্থির করল, সে আজ আহারের খোঁজে বাইরে যাবে না। তাহলে বেশ কিছু মাছমাসে খেতে পাবে।

এই ঠিক করে সে সেই রাতে পেটের অসুখের ভান করে অভিনয় করতে লাগল। পরদিন সকালে বোধিসত্ত্ব বললেন, ভাই কাক, এবার বাইরে চরতে চল।

কাক বলল, আজ আপনি একাই যান। আমার পেটে বড় ব্যথা হয়েছে।

একথা শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন, কাকের পেটব্যথা বা পেটের রোগ একথা ত প্রতি প্রহরে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে এবং দীপের আলো খেয়ে সে ক্ষুধা মেটায়। দেখে তা খাবার জন্য লালায়িত হয়েছ। কিন্তু যা মানুষের খাদ্য তা তোমার জন্য নয়। সুতরাং আমার সঙ্গে চল। তোমার আহার তুমি খুঁজে নেবে। কখনো শুনিনি। তারা রাত্রিকালে তুমি নিশ্চয় রান্নাঘরে মাছমাসে তোমার তা খাওয়া উচিত নয়।

কাক বলল, আজ আমার খাবার সাধ্য নেই।

বোধিসত্ত্ব বললেন, বেশ, তুমি থাক তাহলে। তোমার ব্যবহারেই তোমার আসল উদ্দেশ্য কি তা জানা যাবে। তবে সাবধান, লোভের বশে যেন কোন অন্যায় কাজ করো না।

কাককে সতর্ক করে তাকে এই উপদেশ দিয়ে আহারের সন্ধানে বেরিয়ে গেলেন বোধিসত্ত্ব।

এদিকে পাচক সেই সব মাছমাংস ভালভাবে রান্না করল। গরম রান্না ঠাণ্ডা হবার জন্য রন্ধনপাত্রগুলির মুখ কিছুটা খুলে রেখে দিল। তারপর ঘরের বাইরে গিয়ে ঘাম মুছতে লাগল।

এমন সময় কাক ঝুড়ি হতে মুখ বাড়িয়ে দেখল পাচক বাইরে গেছে। সে তখন ভাবল মাংস খাবার এই সুযোগ

এসেছে। ভাবল ছোট ছোট করে কাটা টুকরো মাংস অনেকগুলো না হলে পেট ভরবে না। তাই একটা বড় মাংসপিণ্ড নিয়ে তা খেলেই তার পেট ভরে যাবে।

এই ভেবে সে তার ঝুড়ি থেকে উড়ে গিয়ে যে একটা বড় পাত্রে মাংস রাখা ছিল সেই পাত্রের উপর বসল। সঙ্গে সঙ্গে পাত্রটা উল্টে পড়ে গেলে একটা শব্দ হলো। পাচক তখন সেই শব্দ শুনে ঘরে ঢুকে কাককে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে ফেলল। সে তখন বলতে লাগল, ব্যাটা দুষ্টবুদ্ধি চতুর কাক, মাংস খাবার লোভেই আজ তার বন্ধু পারাবতের সঙ্গে বাইরে আহার করতে যায়নি। শয়তানি করে ঝুড়িতে বসে ছিল। আমি আমার মালিকের জন্য কত কষ্টে মাংস রান্না করেছি। সেই মাংস ও খেতে এসেছে। মজা দেখাচ্ছি ওকে।

এই বলে পাচক কাকের দেহ হতে সব পালক ছাড়িয়ে দিয়ে নুন ও জীরে বেঁটে টক ঝোলের সঙ্গে মিশিয়ে কাকের সারা দেহে মাখিয়ে দিল। তারপর তাকে ঝুড়িতে বসিয়ে দিল। কাকের সারা দেহ জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল সারাদিন।

সন্ধ্যার সময় বোধিসত্ত্ব বাসায় ফিরে এসে কাকের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি

ভাবলেন, লোভী কাক আমার কথা না শুনে সমুচিত শাস্তি পেয়েছে। সে এখন নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করছে। তিনি তখন এই নীতি উপদেশের কথাটি বললেন, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী, যে হিতৈষী বন্ধুর কথা শোনে না, তার

এমনি বিপত্তিই হয়। তার প্রমাণ দেখ এই কাক।

তিনি তখন মনে মনে স্থির করলেন, আমি আর এখানে থাকতে পারি না। এই কাকের জন্য আমার সুনাম নষ্ট হলো। পাচক হয়ত আমাকে আর আগের মত স্নেহের চোখে দেখবে না।

এই ঠিক করে তিনি অন্যত্র চলে গেলেন। তখন কাকও আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সেইখানেই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। পাচক ঝুড়িসুদ্ধ কাককে বাইরে আবর্জনারাশির মধ্যে ফেলে দিল।

Leave a Reply